হিমালয় হতে আসিলে নামিয়া তুষার বসন ত্যাজি,
হিমের স্বপন অঙ্গে মাখিয়া সাঁঝের বসনে সাজি।
হে গিরি দুহিতা তোমার নয়নে অলকার মেঘগুলি,
প্রতি সন্ধ্যায় পরাইয়া যেত মায়া-কাজলের তুলি।
তুহিন তুষারে অঙ্গ মাজিতে দুগ্ধধবল কায়,
রবির কিরণ পিছলি পিছলি লুটাত হিমানী বায়!
রাঙা মাটি পথে চলিতে চলিতে পথ যেন মমতায়,
আলতা রেকায় রঙিন হইয়া জড়াইত দুটি পায়।
অলকে তোমার পাহাড়ী পবন ফুলের দেউল লুটি,
গন্ধের বাসা রচনা করিত সারা রাত ছুটি ছুটি।
গহিন গুহার কুহরে কুহরে কলকল্লোলে ঘুরি,
ঝরণা তোমার চরণ বিছাত মণি-মানিকের নুড়ি!
পাষাণের ভাষা শুনিতে যে তুমি ঝরণায় পাতি কান,
শুনিতে শুনিতে কোন অজানায় ভেসে যেত তব প্রাণ!
ঝরণার স্রোতে ভাসিয়া আসিত অলস সোনার ঘুম,
তোমার মায়াবী নয়নে বিছাত দূর স্বপনের চুম।
শিথিল দেহটি এলাইয়া দিয়া ঘন তুষারের গায়,
ঘুমায়ে ঘুমায়ে ঘুমেরে যে ঘুম পাড়াইতে নিরালায়।
তোমার দেহের বিম্ব আঁকিয়া আপন বুকের পরে,
পরতের পর পরত বিছাত তুষার রজনী ভরে।
তোমার ছাষায় যত সে লুকাত, চাঁদের কুমার তত
তুষার পরত ভেদিয়া সেথায় একেলা উদয় হ।
দূর গগনের সাত-ভাই তারা শিয়রে বিছায়ে ছায়া,
পারুল বোনের নিশীথ শয়নে জ্বালতে আলোর মায়া।
দিন রজনীর মোহনার সোঁতে শুক-তারকার তরী,
চলিতে চলিতে পথ ভুলে যেন ঘাটের বাঁধন স্মরি।
পূর্ব তোরণে দাঁড়ায়ে প্রভাত ছুঁড়িত আবীর ধূলি,
তোমার নয়ন হইতে ফেলিত ঘুমের কাজল তুলি।
কিশোর কুমার, প্রথম হেরিয়া তোমার কিশোরী কায়া,
মেঘে আর মেঘে বরণে বরণে মাখাত রঙের মায়া।
কি কুহকে ভুলে ওগো গিরিসুতা! এসেছ মরতে নামি,
কে তোমার লাগি পূজার দেউল সাজায়েছে দিবা-যামি।
হেথয় প্রখর মরীচি-মালীর জ্বলে হুতাশন জ্বালা,
দহনে তোমার শুকাবে নিমেষে বুকে মন্দার মালা।
মরতের জীব বৈকুন্ঠের নাহি জানে সন্ধান,
ফুলের নেশায় ফুলেরে ছিঁড়িয়া ভেঙে করে শতখান।
রূপের পূজারী রূপেরে লইয়া জ্বালায় ভোগের চিতা,
প্রেমেরে করিয়া সেবাদাসী এরা রচে যে প্রেমের গীতা।
হাত বাড়ালেই হেথা পাওয়া যায়, তৃষ্ণারে বড় করি,
তপ-কৃষ তনু গৈরিকবাসে জাগেনাক বিভাবরী।
হেথা সমতল, জোয়ারের পানি একধার হতে ভাসি,
আরধারে এসে গড়াইয়া পড়ে ছল-কল-ধারে হাসি।
হেথায় কাম সহজ লভ্য, পরিয়া যোগীর বাস,
গহন গুহায় যোগাসনে কেউ করে না কাহারো আশ।
হেথাকার লোক খোলা চিঠি পড়ে, বন-রহস্য আঁকি,
বন্ধুর পথে চলে না তটিনী কারো নাম ডাকি ডাকি।
তুমি ফিরে যাও হে গিরি-দুহিতা, তোমার পাষাণ পুরে,
তোমারে খুঁজিয়া কাঁদিছে ঝরণা কুহরে কুহরে ঘুরে।
তব মহাদেব যুগ যুগ ধরি ভস্ম লেপিয়া গায়,
গহন গুহায় তোমার লাগিয়া রয়েছে তপস্যায়।
অলকার মেয়ে! ফিরে যাও তুমি, তোমার ভবন-দ্বারে,
চিত্রকূটের লেখন বহিয়া ফেরে মেঘ জলধারে।
তোমার লাগিয়া বিরহী যক্ষ গিরি-দরী পথ-কোণে,
পাষাণর গায়ে আপন ব্যথারে মদ্দিছে আনমনে;
শোকে কৃশতনু, বিহবল মন, মৃণাল বাহুরে ছাড়ি,
বার বার করে ভ্রষ্ট হইছে স্বর্ণ-বলয় তারি।
বাণীর কুঞ্জে ময়ূর ময়ূরী ভিড়ায়েছে পাখা তরী,
দর্ভ-কুমারী, নিবারের বনে তৃণ আছে বিস্মরি।
তুমি ফিরে যাও তব আলকায়, গৌরী গিরির শিরে,
চরণে চরণে তুষার ভাঙিও মন্দাকিনীর তীরে।
কন্ঠে পরিও কিংশুকমালা, পাটল-পুষ্প কানে,
নীপ-কেশরের রচিও কবরী নব আষাঢ়ের গানে।
তীর্থ পথিক বহু পথ বাহি শ্রান্ত ক্লান্ত কায়,
কোন এক প্রাতে যেয়ে পৌছিব শিঞ্চল গিরি ছায়।
দিগ জোড়া ঘন কুয়াশার লোল অঞ্চলখানি,
বায়ুরথে বসি কিরণ কুমার ফিরিবে সুদূরে টানি।
আমরা হাজার নব নারী হেথা রহিব প্রতীক্ষায়,
কোন শুভখনে গিরি-কন্যার ছায়া যদি দেখা যায়।
দিবসের পর দিবস কাটিবে, মহাশূন্যের পথে,
বরণের পর বরণ ঢালিবে উতল মেঘের রথে।
কুহকী প্রকৃতি মেঘের গুচ্ছে বাঁধিয়া বাদল ঝড়,
ঘন ঘোর রাতে মহাউল্লাসে নাচিবে মাথার পর।
ভয়-বিহবল দিবস লুকাবে কপিল মেঘের বনে,
খর বিদ্যুৎ অট্ট হাসিবে গগনের প্রাঙ্গণে।
তীর্থ-পথিক তুব ফিরিবে না, কোন শুভদিন ধরি,
বহুদূর পথে দাঁড়াবে আসিয়া গৌরী গিরির পরী।
সোনার অঙ্গে জড়ায়ে জড়ায়ে বিজলীর লতাগুলি,
ফুল ফোটাইবে, হাসি ছড়াইবে অধর দোলায় দুলি।
কেউ বা দেখিবে, কেউ দেখিবে না, অনন্ত মেঘ পরে,
আলোক প্রদীপ ভাসিয়া যাইবে শুধু ক্ষণিকের তরে।
তারপর সেথা ঘন কুয়াশার অনন্ত আঁধিয়ার,
আকাশ-ধরনী, বন-প্রান্তর করে দেবে একাকার।
আমরা মানুষ-ধরার মানুষ এই আমাদের মন,
যদি কোনদিন পরিতে না চাহে কুটীরের বন্ধন;
যদি কোনদিন সুদূর হইতে আলেয়ার আলো-পরী,
বেঘুম শয়ন করে চঞ্চল ডাকি মোর নাম ধরি।
হয়ত সেদিন বাহির হইব, গৃহের তুলসী তলে,
যে প্রদীপ জ্বলে তাহারে সেদিন নিবায়ে যাইব চলে।
অঙ্গে পরিব গৈরিক বাস, গলায় অক্ষহার,
নয়নে পরিব উদাস চাহনী মায়া মেঘ বলাকার।
কাশীশ্বরের চরণ ছুঁইয়া পূতপবিত্র কায়,
জীবনের যত পাপ মুছে যাব প্রয়াগের পথ গায়।
হরিদ্বারের রঙিন ধূলায় ঘুমায়ে শ্রান্ত কায়,
ত্রিগঙ্গা জলে সিনান করিয়া জুড়াইব আপনায়।
কমন্ডলুতে ভরিয়া লইব তীর্থ নদীর বারি,
লছমন ঝোলা পার হয়ে যাব পূজা-গান উচ্চারি।
তাপসীজনের অঙ্গের বায়ে পবিত্র পথ ছায়ে,
বিশ্রাম লভি সমুকের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে।
বিশ্রাম লভি সমুখের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে।
দেউলে দেউলে রাখিব প্রণাম, তীর্থ নদীর জলে
পূজার প্রসূন ভাসাইয়া দিব মোর দেবতারে বলে।
মাস-বৎসর কাটিয়া যাইবে, কেদার বদরী ছাড়ি,
ঘন বন্ধুর পথে চলিয়াছে সন্যাসী সারি সারি,
কঠোর তাপেতে ক্ষীন্ন শরীর শ্রান্তক্লান্ত কায়,
সমুখের পানে ছুটে চলে কোন দুরন্ত তৃষ্ণায়।
সহসা একদা মানস সরের বেড়িয়া কণক তীর,
হোমের আগুন জ্বলিয়া উঠিবে হাজার সন্ন্যাসীর।
শিখায় শিখায় লিখন লিখিয়া পাঠাবে শূন্যপানে,
মন্ত্রে মন্ত্রে ছড়াবে কামনা মহা-ওঙ্কার গানে।
তারি ঝঙ্কারে স্বর্গ হইতে বাহিয়া কণক রথ,
হৈমবতীগো, নামিয়া আসিও ধরি মর্ত্ত্যের পথ।
নীল কুবলয় হসে- ধরিও দাঁড়ায়ে সরসী নীরে,
মরাল মরালী পাখার আড়াল রচিবে তোমার শিরে।
প্রথম উদীতা-ঊষসী-জবার কুসুম মূরতি ধরি,
গলিত হিরণ কিরণে নাহিও, হে গিরি দুহিতা পরি।
অধর ডলিয়া রক্ত মৃণালে মুছিও বলাকা পাখে,
অঙ্গ ঘেরিয়া লাবণ্য যেন লীলাতরঙ্গ আঁকে।
চারিধার হতে ভকত কন্ঠে উঠিবে পূজার গান,
তার সিঁড়ি বেয়ে স্বরগের পথে করো তুমি অভিযান।
তীর্থ-পথিক, ফিরিয়া আসিব আবার মাটির ঘরে,
গিরি গৌরীর বাহিনী আনিব কমন্ডলুতে ভরে।
দেউলে দেউলে গড়িব প্রতিমা, পূজার প্রসূন করে,
জনমে জনমে দেখা যেন পাই প্রণমিব ইহা স্মরে।
গৌরী গিরির মেয়ে
Did you enjoy the the artible “গৌরী গিরির মেয়ে” from Jasimuddin on OZOFE.COM? Do you know anyone who could enjoy it as much as you do? If so, don't hesitate to share this post to them and your other beloved ones.
Leave a Reply